এখন প্রশ্ন হলো কোন সাক্ষ্য? আপনি ন্যায়ের পথে যে সাক্ষ্য দেন সকল সাক্ষ্যই এর অন্তর্ভুক্ত। আর, মুমিনের সবচেয়ে বড় সাক্ষ্যই হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য মানা যাবে না এই সাক্ষ্যটি যেটি জেনে বুঝে ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে ইমান আনতে হয় , সুতরাং এ সাক্ষ্যকে দুনিয়ার জীবনে বাস্তবায়ন করা আপনার আমার সবার জন্য ফরজ।
এই সাক্ষ্য বাস্তবায়নের অর্থ হল- মুখে যে ঘোষনাটা দিচ্ছেন- আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য মানেন না, ব্যক্তি জীবনেও কুরআনের দিকনির্দেশনার বাহিরে কোন কাজ করা যাবে না। সমাজে, রাষ্ট্রে এমনকি সারাপৃথিবীর মানুষ যাতে শুধুমাএ এই কালেমার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, তার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাইতে হবে।
আর এই কালেমার সাক্ষ্যটি দুনিয়াতে বাস্তবায়ন করতে পারলে সকল অশান্তির অবসান হবে।
সরকার যদি পুলিশকে আদেশ দেয়, নিরাপরাধ মানুষকে গুলি করতে, পুলিশ তা করবে না, যদি করে সরকার ইলাহ হয়ে যাবে। মানুষ যখন এই ভাবাদর্শ লালন করবে, তখন কোন সরকার স্বৈরশাসক বা তাগুত হতে পারবে না।
আপনার স্ত্রী আপনার বাবা-মায়ের দেখাশোনা না করতে বললে, আপনি তা শুনবেন না। শুনলে আপনার স্ত্রী আপনার ইলাহ হয়ে যাবে।
আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে যৌতুক চাইলে, সে আপনাকে মানবে না।
আপনার বাবা-মা আপনার কাছে অন্যায় আবদার করলে, আপনি শুনবেন না, শুনলে বাবা-মা ইলাহ হয়ে যাবে।
কালেমা প্রতি কাজে আপনাকে কুরআনের কাছে যেতে বাধ্য করবে।
এখন, কালেমায় যে সাক্ষী দেন, সেটা কিভাবে কায়েম/বাস্তবায়ন করবেন?
সোজা উত্তর, আল্লাহর জমীনে আল্লাহ ছাড়া মানুষ কারো আনুগত্য যাতে না করে তার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
রাসুলের জীবনী থেকেও আমরা জানি যে, রাসুল শুধুমাত্র একটি জিনিসের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। মক্কার সকল নেতাকে উদ্দেশ্য করে রাসুল (স) বলেছেন:
فَقَالَ رَسُولُ اللهِ: نَعَمْ، كَلِمَةٌ وَاحِدَةٌ تُعْطُونِيَهَا تَمْلِكُونَ بِهَا الْعَرَبَ، وَتَدِينُ لَكُمْ بِهَا الْعَجَمُ. قَالَ: فَقَالَ أَبُو جَهْلٍ: نَعَمْ وَأَبِيكَ، وَعَشْرَ كَلِمَاتٍ. قَالَ: تَقُولُونَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَتَخْلَعُونَ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ. قَالَ: فَصَفَقُوا بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ قَالُوا: أَتُرِيدُ مُحَمَّدُ أَنْ تَجْعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا؟ إِنَّ أَمْرَكَ لَعَجَبٌ.
"যদি তোমরা আমাকে একটি কথা মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার দাও তাহলে তোমরা সেই একটি কথার মাধ্যমে গোটা আরব বিশ্বের মালিক বনে যাবে এবং অনারব বিশ্ব হয়তো তোমাদের দ্বীন/তোমরা যা মেনে চল তা গ্রহণ করবে অথবা তোমাদের কর দিয়ে থাকবে।" এ কথা শুনে আবু জাহল বললো, "অবশ্যই! তোমার পিতার কসম, আরো দশটি কথা মানবো।" রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, "সেই একটি কথা হলো তোমরা বলবে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'/ আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য মেনে কাজ করব না। এক আল্লাহর ইবাদত/আনুগত্য মেনে কাজ করবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য যা কিছুর ইবাদত/আনুগত্য মেনে কাজ করা হয়, সবকিছুকে ত্যাগ করবে।" এ কথা শুনামাত্র সকলেই হাতে তালি দিতে শুরু করলো আর বললো, "হে মুহাম্মাদ, তুমি কি আমাদের সকল ইলাহকে/যাদের আনুগত্য মেনে কাজ করা হয় এমন সকলকে এক আল্লাহতে কেন্দ্রীভূত করতে চাও? তোমার ব্যাপারটি বড় আশ্চর্যজনক।" (সীরাত ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪৮০)
মক্কার লোকেরা এই যে কালিমার বিরোধিতা করেছিল, এটা কিন্তু তারা জেনে বুঝেই করেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে এই কালিমা গ্রহণ করার অর্থ হলো আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো আনুগত্য করা যাবে না। আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কোনো নেতা-নেত্রীর আনুগত্য করা যাবে না। আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে মানবরচিত কোনো আইন-বিধান মানা যাবে না। ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে, আন্তর্জাতিক জীবনে, ব্যাংকে, আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে সকল ক্ষেত্রে এক আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করতে হবে।
আবার, যেমনি ভাবে ,
বর্তমানে ক্ষমাতাসীন বেশীরভাগ মানুষ নিজ নিজ জায়গায় ইলাহের আসনে বসে আছে-পরিবারে, সমাজে, অফিসে,রাজনৈতিক দলে, পার্লামেন্টে, সরকারে,
তেমনিভাবে ,
তৎকালীন আবু জাহেল, আবু লাহাব, আবু সুফিয়ানরাও ইলাহের আসনে বসে ছিল। তারা জানতো, এর বিরোধীতা না করলে তাদের ক্ষমতা হারাতে হবে কেননা কালেমা আল্লাহ ছাড়া সকলের আনুগত্য অস্বীকার করে। এই কারনে, সকল নবী রাসুল সহ যেই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর দাওয়াত দিয়েছে, তাদের সর্বপ্রথম বিরোধিতা করেছিল সেখানকার তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা যারা মুলত নিজেদেরকে ইলাহের আসনে বসিয়ে রেখেছিল । এই কারনে, এসবকিছু বুঝে-শুনেই তারা বিরোধিতা করেছিল। পবিত্র কুরআনে তাদের বক্তব্যকে সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নের আয়াতে বলা হয়েছে:
أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ
"তবে কি সে সকল ইলাহগুলোকে এক ইলাহতে কেন্দ্রীভূত করে ফেলল? এতো অত্যন্ত আজব কথা।" (সোয়াদ, ৩৮: ৫)
অমুসলিমদের সাথে মুসলিমদের মূল পার্থক্য হল—ইসলাম বলে এক আল্লাহরই আনুগত্য করতে হবে, অন্য ধর্ম বলে—আল্লাহর আনুগত্যও মানবো এবং অন্যদের কথাও মানবো। কিতাবুল ইমান (২য় সংস্করণ পৃষ্ঠা: ১১২ থেকে ১১৩) মুফতী মুহাম্মদ জসীমুদ্দীন
ইলাহ অর্থ আল্লাহ নয়, আর এক আল্লাহতে বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস তখনো করতো এবং এখনো করে।
আবার, আল্লাহ বলেন:
وَلَئِن سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللّٰهُ
"যদি তুমি তাদেরকে (মুশরিকদের) জিজ্ঞেস করো: কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং চাঁদ-সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ করছেন? তারা অবশ্যই বলবে: আল্লাহ!" (আনকাবুত ২৯:৬১)
আরো পাবেন এই নিম্নের আয়াতগুলোতে:
- Az-Zukhruf ৪৩:৮৭
- Az-Zumar ৩৯:৩৮
- Surah Luqman ৩১:২৫
- Surah Jumar ৩৯:৩৮
অমুসলিমরাও সর্বশক্তিমান এক আল্লাহতেই বিশ্বাস করে। তবে মুসলিমদের এক আল্লাহর বিশ্বাস এবং অমুসলিমদের এক আল্লাহর বিশ্বাস এক নয়, কারণ ইসলাম বলে এক আল্লাহরই আনুগত্য করতে হবে, অন্য ধর্ম বলে—আল্লাহর আনুগত্যও মানবো এবং অন্যদের কথাও মানবো।
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللّٰهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
"তাদের অধিকাংশ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, কিন্তু (ইবাদাতে) আল্লাহর সাথে অন্যদের অংশীদার করে অনেককে।" (ইউসুফ ১২:১০৬)
আল্লাহকে বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে। কিন্তু আল্লাহ একজন আছেন শুধুমাত্র এই বিশ্বাসের নাম ইমান নয়। ইমান হল—আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য মেনে কোন কাজ করা যাবে না, এই বিশ্বাস মজবুতভাবে ধারণ করা।
কেউ যদি কোনো ভালো কাজের কথা বলে, তখনও কি তার আনুগত্য করা যাবে না?
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
"সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।" (আল-মানিদাহ ৫:২)
যে কোনো ভালো কাজে সহযোগিতা, এটা আল্লাহর নির্দেশ। তাই, আপনাকে চিন্তা করতে হবে, যে ভালো কাজ করতে বলেছে, আপনি তার আনুগত্য করতেছেন না, বরং আল্লাহ অনুমতি দিয়েছে বলেই তার কাজে সহযোগিতা করছেন।
আমরা রাসুলের দেখানো পথে আমাদের প্রতিদিনের কাজকর্ম কেন করি? কারণ আল্লাহ অনুমতি দিয়েছে বলেই করি, না হয় করতাম না। তাই রাসুলের দেখানো পথে চলা, এটাও আল্লাহর আনুগত্যেরই অংশ।